![]() |
| রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
*রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ' গোরা ( ১৯০৯ খ্রিঃ ) :
*' গোরা ' সূচনা : বাংলা উপন্যাসে ভারত - চিন্তা ও জাতীয়তাবোধের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ' গোরা ' । ‘ গোরা ' একটি উপন্যাস । এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে । তখন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দেশের চিত্তকে আলোড়িত করেছে । তাই রবীন্দ্রনাথকে কোনো ঐতিহাসিক বা রোমান্টিক কাহিনির আশ্রয় নিতে হয়নি বা পাঠককে আকৃষ্ট করবার জন্য কোনো বীরকেও আনতে হয়নি ।
*ভারতের সত্য পরিচয় : রবীন্দ্রনাথের ভারতবর্ষ আমাদের সবার পরিচিত । সকল ত্রুটি , দুর্বলতা , কুসংস্কার , দারিদ্র ও অম্লতা মিলিয়ে সেই ভারতবর্ষ । এটাই সব নয় । সত্যনিষ্ঠা , ত্যাগ , বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও মিলন , মানবতা , বিশ্বজনীন ভালবাসা এবং সর্বভূতে প্রীতি— এটাই ভারতবর্ষ , এটাই ভারতবর্ষের সত্যমূর্তি । উপন্যাসের নায়ক গোরা ভারতবর্ষের সত্য মূর্তি উপলব্ধি করার জন্য এবং সকলকে তা উপলব্ধি করাবার জন্য ব্যাকুল । সে বিনয়কে বলছে— “ সত্যের ছবি স্পষ্ট দেখতে না পেলে লোকে আত্মসমর্পণ করবে কোন্ উপছায়ার কাছে ? ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মূর্তিটা সবার কাছে তুলে ধরো লোকে তা হলে পাগল হয়ে যাবে । প্রাণ দেবার জন্য ঠেলাঠেলি পড়ে যাবে । ”
*গোরা - র দেশপ্রেম : কে এই গোরা ? সে নিষ্ঠাবান ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ কৃষ্ণদয়াল ও আনন্দময়ীর সন্তান । সে নিষ্ঠাবান স্বদেশি , নিষ্ঠাবান ভারতীয় , নিষ্ঠাবান হিন্দু , নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ , নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিক এবং নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মী । ভারতের সীমাহীন দুঃখ - দারিদ্র্যা , অভাব - অনটন ও অজস্র ত্রুটি সত্ত্বেও ভারতবর্ষের প্রতি তাঁর সীমাহীন ভালোবাসা সীমাহীন শ্রদ্ধা এ কারণেই পথে - ঘাটে কোনো ইংরেজের সঙ্গে মারামারি করতে পারলেই সে । তাঁর জীবন ধন্য বলে মনে করত । ভারতবর্ষের নানা প্রকাশ ও নানা বিচিত্র চেষ্টার মধ্যে সে এক গভীর ও বৃহৎ ঐক্য প্রত্যক্ষ করেছে । ভারতের মূঢ়তম মানুষটিও তার আপনজন । তার মতে এই মুঢ় মানুষগুলির মধ্যেই লুকিয়ে আছে চিরন্তন ভারতবর্ষ ।
*গোরার আদর্শ : সুচরিতা জানতে চাইল যে , গোরা বিশেষ কোনো দলভুক্ত কিনা তখন সে নিঃসঙ্কোচে জানাল যে সে হিন্দু । সে নিজেই বলছে যে , হিন্দু কোনো দল নয় – হিন্দু একটা জাতি । এই জাতি এত বৃহৎ যে , এই জাতির জাতিত্ব কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবন্ধ করা যায় না । হিন্দুধর্ম মায়ের মতো নানা ভাবের ও নানা মতের মানুষকে কোল দেবার চেষ্টা করেছে । একমাত্র হিন্দুধর্মই জগতে সব মানুষকে মানুষ বলে স্বীকার করেছে । হিন্দুধর্ম মৃঢ়কেও মানে জ্ঞানীকেও মানে এবং কেবলমাত্র জ্ঞানের কোনো বিশেষ রূপকে মানে না — জ্ঞানের সকল প্রকার বিকাশকেই মানে ।
*গোরার উত্তরণ : গোরার কাছে এই হল হিন্দুধর্মের সার্বজনীন রূপ । হিন্দুদের ঔদার্য নিয়ে সে যখন গৌরব বোধ করছে , তখন সে বিন্দুমাত্র আভাসও পায়নি যে , অচিরেই তার জন্মপরিচয় উদ্ঘাটিত হবে এবং সেই মুহূর্তেই ভারতবর্ষের সব মন্দিরের দ্বার তার কাছে রুদ্ধ হয়ে যাবে । এত বড়ো আঘাতে গোরা ভেঙে পড়েনি বা অভিমানে দুরে সরে যায়নি । এতদিন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যে গৌরববোধ তার চারদিকে যে বেষ্টনী সৃষ্টি করে রেখেছিল , তা থেকে মুক্তি পেয়ে সে ভারতের অন্তরাত্মার একেবারে অন্তরতম হয়ে ওঠার সুযোগ পেল । সে ব্রাহ্মণ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছিল — জানল যে তার সে পরিচয় মিথ্যা । জন্মসূত্রে সে খ্রিস্টান । সিপাহি বিদ্রোহের কালে এক পলায়নপর আইরিশ নারীর গর্ভে তার জন্ম । সকল ধর্ম ও সংস্কারের বন্ধন থেকে বিরোধ নেই । আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতই আমার জাত , সকলের অম্লই আমার অন্ন । অকস্মাৎ মুক্তি পেয়ে গোরা বলছে— " আজ আমি ভারতবর্ষীয় । আমার মধ্যে হিন্দু , মুসলমান , খ্রীষ্টান কোনো সমাজের
*গোরার ভারতবর্ষঃ এমন ভারতবর্ষ শুধুই কল্পনা নয় । সেই ভারতবর্ষের প্রতীক আনন্দময়ী— গোরার পালিকা মা । আত্মপরিচয় জানার পর আনন্দময়ীকে প্রণাম করে গোরা বলল , “ মা , তুমিই আমার মা । যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন । তোমার জাত নেই , বিচার নেই , ঘৃণা নেই — শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা । তুমিই আমার ভারতবর্ষ । ” গোরা আনন্দময়ীকে শ্রদ্ধা করত , ভালোবাসত , মা বলে ডাকত , কিন্তু আগে কখনও তাঁকে ভারতবর্ষের প্রতীক হিসেবে দেখেনি । এই দেখাটা সহজ হল যখন সে জানল যে , নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ - গৃহিনী হয়েও আনন্দময়ী অনাথ খ্রিস্টান শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়ে নিজ সন্তানের মতোই মানুষ করেছেন এবং মাতৃস্নেহের অকৃপণ দানে গোরার জীবন ধন্য করেছেন ।
*প্রকৃত ভারত : আনন্দময়ীর মতো ভারতবর্ষেরও কোনো জাতি নেই — জাতি থাকলে এত জাতিকে সে আশ্রয় দিত কী করে ? ভারতবর্ষ কাউকে ঘৃণা করে না । ঘৃণা করলে , তার বুকের ওপর বসে এত ঘৃণ্য আচরণ কী করে সম্ভব হত ? এই অপরিসীম সহনশীলতা ও সুগভীর স্নেহ দিয়ে ভারতবর্ষ বহু শতাব্দী ধরে কত বিচিত্র নরনারীকে বেঁধে রেখেছে । রবীন্দ্রনাথের যে ভারতবর্ষ সেখানে সহস্র বৈচিত্র্য থাকতে পারে , কিন্তু সংকীর্ণতার স্থান নেই সেখানে । সংকীর্ণতার গণ্ডি যারা ভাঙতে পেরেছে তারাই কবির আদর্শ ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব লাভ করে ধন্য হয়েছে । গোরা , সুচরিতা , বিনয় , ললিতা — এরা সকলেই সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠে স্থান পেয়েছে ভারতবর্ষের অন্তরে ।
*তথ্যসংগ্রহ
- স্বদেশ পরিচয় ও পরিবেশ --- জীবন মুখোপাধ্যায়
